হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যে বছর তাঁর জন্মভূমি পবিত্র মক্কা নগরী থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন ওই বছর থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা হয়। তাঁর হিজরতের প্রথম বছরকে হিজরি সনের প্রথম বছর বলে গণ্য করা হয়। তাই এটি হিজরি সন নামে পরিচিত। সৌরবর্ষ তথা বাংলা সন এবং চান্দ্রবর্ষ উভয় সনের মূল ভিত্তি মহানবী (সা.) এর হিজরতের সনকে কেন্দ্র করে। সৌরবর্ষে ৩৬৫ ও ৩৬৬ দিনে বছর হয় এবং চান্দ্রবর্ষে ৩৫৪ ও ৩৫৫ দিনে বছর হয়। এই ব্যবধানকে কেন্দ্র করে চান্দ্রবর্ষ বর্তমানে ১৪৪৫ হিজরি এবং সৌরবর্ষ বর্তমানে ১৪৩০ বাংলা চলতেছে। সূর্যের চারদিকে পৃথিবী আবর্তনের সময়কালকে সৌরবর্ষ এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদ আবর্তনের সময়কালকে চান্দ্রবর্ষ বলে। মহান প্রভু পবিত্র কোরআনে কারিমে ঘোষণা করেন, ‘সূর্য এবং চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে’ (সুরা আর রহমান-৫)। ইসলামী শরিয়তের ফিক্হ বিধানসমূহে বছর বলতে চান্দ্রবর্ষকেই বোঝানো হয়। যাবতীয় ধর্মীয় বিধিবিধান চন্দ্র তারিখ এবং চান্দ্রবর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত। নামাজ, রোজা, হজ পালন ও জাকাত আদায় এবং ঈদ উদযাপন করা একমাত্র চন্দ্র তারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল। মুসলিম উম্মাহর তাহজিব, তামাদ্দুন ও ইতিহাস, ঐতিহ্য হিজরি সনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচার এবং সামাজিক জীবনে এই সনের মূল্যায়ন অপরিসীম। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, সাহাবি আবু মুসা আশআরি (রা.) একটি পত্রে খলিফা ওমর (রা.)-কে জানান, আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠিপত্র পাঠাচ্ছেন সেগুলোতে সন-তারিখ উল্লেখ থাকে না, ফলে কোনটি আগে পাঠিয়েছেন বা পরে পাঠিয়েছেন তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয়। আপনার নির্দেশনা প্রয়োগেও অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওমর (রা.) একটি সন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অপর এক বিবরণ অনুযায়ী, খলিফা নিজ উদ্যোগেই এই সন প্রবর্তন করেন এবং এর প্রচলন ঘটান। তিনি এক দিন দাফতরিক এক কাগজে শুধু তারিখ লেখা দেখতে পান। এতে কোনো সন উল্লেখ ছিল না। কাল অতিক্রমে কীভাবে তা চিহ্নিত করা হবে তা নিয়ে খলিফা উদ্বিগ্ন হয়ে একটি সন প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের ১৬ বছর পর তাঁর খেলাফত আমলে শীর্ষস্থানীয় সাহাবাগণের পরামর্শক্রমে ১০ জুমাদাল উলা মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই হিজরি সন প্রবর্তনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাহাবি হজরত আলী (রা.) হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ প্রদান করেন এবং সাহাবি হজরত উসমান (রা.) মহররম মাস থেকে বর্ষ সূচনা করার পরামর্শ প্রদান করেন (সহিহ বুখারি, আবু দাউদ)।
মহররম অর্থ সম্মানিত। ইসলামী ইতিহাসের অগণিত স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা এই মাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ছাড়া এ মাসটিকে মহান প্রভু শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এমন অনেক কারণে এই মাসটি সম্মানিত, অতি সম্মানিত। তাই হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে এই মহররম মাসকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মোটকথা, ইতোমধ্যে হিজরি সনের ১৪৪৪টি বছর পার হয়ে ১৪৪৫তম বছর শুরু হয়েছে। নতুন বছরকে আমরা স্বাগত জানাই। সঙ্গে সঙ্গে বিগত বছরের হিসাব করা এবং নতুন বছরে করণীয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করাও বুদ্ধিমানের পরিচয়। তাই আসুন, বিগত বছরের যাবতীয় অবহেলার জন্য তওবা ও ইস্তাগফার করি। আর নতুন বছরে ভালো কাজের আশা ও ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যাই।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা