রওজা শরীফের বিপরীতে বরাবর দক্ষিণ পাশে একটি খোলা জানালা। সুদীর্ঘ ১৪০০ বছর যাবত জানালাটি খোলা রয়েছে। এটা ভালোবাসার খোলা জানালা! এটা হযরত হাফসা রাদি. এর জানালা। এ জানালা যুগের পরিবর্তনে বন্ধ হয়নি কখনো। এই জানালার একটি দারুণ ইতিহাস রয়েছে। যার জন্য এই জানালাটি প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত খোলা।
রওজা মুবারকে সালাম দেয়ার জন্য পশ্চিম দিক থেকে প্রবেশ করে পূর্ব দিকে বের হতে হয়। রওজা শরীফ বরাবর এসে হাতের বামে উত্তর মুখি হয়ে সালাম প্রদান করতে হয়। যখন আপনি রওজা শরীফের দিকে মুখ করে সালাম পেশ করছেন তখন ঠিক আপনার পিঠের পেছনে দক্ষিণ পাশের দেয়ালে রয়েছে এই খোলা জানালা।
নবীজি সা. যেখানে শুয়ে আছেন সেটি হল আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহার হুজরা মোবারক। বর্তমানে যেটি রওজা মুবারক। ঠিক তার বিপরীত দিকে দক্ষিণ পাশের দেয়ালে জানালাটি অবস্থিত। সেটি হল ওমর রাযিয়াল্লাহুর কন্যা আম্মাজান হাফসা রাযিআল্লাহু আনহার বাসস্থান।
মসজিদে নববীর পূর্ব পাশে সারিবদ্ধভাবে নবীজির স্ত্রীদের হুজরা নির্মিত ছিল। আম্মাজান আয়েশা এবং আম্মাজান হাফসা রাযিআল্লাহু আনহুমাদের হুজরা দু’টি মুখোমুখি ছিল। মাঝে ছিল একটি গলিপথ। যে গলিপথ দিয়ে সবাই রওজায় সালাম করতো।
নবীজির ইন্তেকালের পর আবু বকর সিদ্দিক রাজিয়াল্লাহু আনহুর যুগ সমাপ্ত হলো। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতে ১৭ হিজরীতে মসজিদে নববী সম্প্রসানের প্রয়োজন দেখা দিল। বিশেষ করে রওজায় সালাম দেয়ার সুবিধার্থে হাফসা রাযিআল্লাহু আনহার হুজরাটি সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন দেখা দিল। যে হুজরায় তখনো তিনি অবস্থান করছিলেন।
নবীজি ভূপৃষ্ঠে নেই তো কি হয়েছে! চোখের সামনেই তো রয়েছে নবীজির রওজা। রওজার পাশেই এই হুজরা খানায় তিনি নবীজির স্মরণ নিয়ে বসবাস করতেন। আর যখনই মন চাইতো এই জানালা দিয়ে প্রাণপ্রিয় স্বামীর রওজার দিকে তাকিয়ে আত্মাকে প্রশান্ত করতেন। মন ভরে দুরুদ ও সালাম পেশ করতেন। আর অনুভব করতেন, এইতো কয়েক হাতের দূরত্বে নবীজির পাশে নবীজির সঙ্গেই তিনি আছেন। ওমর রাজিয়াল্লাহু আনহু বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিভাবে তিনি হাফসাকে বলবেন এই হুজরাটি ছেড়ে দেয়ার জন্য!
একদিন তিনি পিতৃস্নেহ ও পরম মমতা নিয়ে মেয়ের সাথে দেখা করতে গেলেন। খোঁজখবর নেয়ার পর কথা প্রসঙ্গে বিষয়টি তাঁর সামনে তুলে ধরলেন।
দীর্ঘ ৭ বছর যাবত নবীজির বিরহ যন্ত্রণায় যিনি ছটফট করছেন। আশা ছিলো জীবনের যে ক’টি দিন বাকি আছে অন্ততঃ রওজার পাশে থেকে কিছুটা শান্তনায় বাঁচবেন। এখানে এসে নবীজি তাঁর পাশে বসতেন। তাঁর সাথে সময় কাটাতেন। এই হুজরার প্রতিটি কোনায় নবীজির স্পর্শ ও স্মৃতি মেখে রয়েছে। এটিও তাঁকে ছাড়তে হবে! বিষয়টি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর কান্না দেখে সেদিনের মতো ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু ফিরে গেলেন।
পরদিন আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে তাঁর কাছে পাঠালেন। আরো অনেকে তাঁকে অনুরোধ করলো। কিন্তু তিনি অনড়। ওমর রাঃ এর পক্ষ থেকে যখনই কেউ তার কাছে এই হুজরা সরানোর আবেদন নিয়ে আসতো তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেন। তাঁকে বলা হলো, এই হুজরার বিনিময়ে মদিনার সবচেয়ে বড় বাড়িটি তাকে উপহার স্বরূপ দেওয়া হবে। তাতেও তিনি রাজি হলেন না। সারা পৃথিবীর সব সম্পদের বিনিময়েও যদি কেউ তাঁকে এই হুজরা ছাড়তে বলতো তবুও তিনি কিছুতেই তাতে রাজি হতেন না।
কিছুদিন পর ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু পুত্র আবদুল্লাহকে সাথে নিয়ে পুনরায় তাঁর কাছে এলেন। এবার ভাই আবদুল্লাহ সবিনয়ে বোনের কাছে আবেদন রাখলেন যেন তিনি উম্মতে মুসলিমার ফায়দার স্বার্থে এ হুজরাটি ছেড়ে দেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাজিয়াল্লাহু আনহুর বাড়িও হাফসা রাযিআল্লাহু আনহার হুজরার সাথেই লাগোয়া ছিল। তিনি বোনকে অনুরোধ করলেন তার বাড়িতে এসে ওঠার জন্য। তিনি বোনের জন্য এই বাড়ি ছেড়ে অন্যখানে চলে যাবেন। আর এ বাড়িটিও তো তাঁর হুজরার সাথেই। সুতরাং তিনি নবীজির কাছেই অবস্থান করবেন।
এবার হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার মন নরম হলো। তিনি তার হুজরা ভেঙে পথ সম্প্রসারণের অনুমতি দিলেন। তবে তিনি শর্ত রাখলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের যে বাড়িতে তিনি উঠছেন রওজা শরীফ বরাবর তার দেয়ালে একটি জানালা খুলতে হবে। আর এই জানালাটি কখনো বন্ধ করা যাবে না। যেন মন চাইলেই তিনি এই জানালা দিয়ে রওজা পানে তাকিয়ে থাকতে পারেন। হযরত ওমর রাজিয়াল্লাহু আনহু ওয়াদা করলেন যে, কখনোই এ জানালাটি বন্ধ করা হবে না।
খেলাফতে ওমর শেষ হলো। ওসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর যুগও সমাপ্ত হলো। হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহাও ইন্তেকাল করলেন। আরো কত শত খলিফা ও রাজা বাদশা গত হলেন! কতবার মসজিদে নববীর পুনঃনির্মাণ ও সম্প্রসারণ হল! কিন্তু কেউই হযরত ওমর রাজিয়াল্লাহু আনহুর কৃত সেই ওয়াদা ভঙ্গ করলেন না।
১৪০০ বছর যাবত স্মৃতি হয়ে থাকল এই খোলা জানালাটি একটি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এবং ওয়াদা রক্ষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ!
এখানে ছবিতে লক্ষ্য করলে নবীজির স্ত্রীদের গৃহসমূহ এবং মসজিদে নববীর অবস্থান বোঝা যাবে। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাজিয়াল্লাহু আনহার হুজরা তথা নবীজির রওজা এবং তার মুখোমুখি হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার হুজরা। আর হাফসা রাযিয়াল্লাহু আনহার হুজরার সাথে লাগোয়া হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাজিয়াল্লাহু আনহুর ঘরও ছবির এই ম্যাপে ফুটে উঠেছে।
সংগৃহীত