অবতরনিকা :
যুগে যুগে মহান প্রভু আল্লাহ তা’আলা এই নশ্বর ধরাধামের ভূ-পৃষ্ঠে বহুমাত্রিক প্রতিভা ও বহুবিধ যোগ্যতা-বৈশিষ্ট সম্পন্ন মহান ব্যক্তিবর্গ আবির্ভূত করে বিশ্ববাসীর উপর স্বীয় কৃপা ও দয়া, করুণা ও মেহেরবাণীর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। যারা আল্লাহ প্রদত্ত প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তায় ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট মানব সমাজকে প্রদান করে থাকেন সঠিক পথের দিশা। সীরাতে মুস্তাক্বীমের সন্ধান। যারা দোলনা থেকে কবর অবধি নিরলস ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং বিরামহীন সাধনা দ্বারা কালের আবর্তনে জাহেলিয়্যাত, অন্ধকার ও কু-সংস্কারে প্রাণঘাতী মহার্ণবে নিমজ্জিত মানবের তরে ঐশী জ্ঞান বিতরণ ও হিদায়তের আলো বিকিরণে হয়ে থাকেন সিদ্ধহস্ত ও নিবেদিতপ্রাণ। যাদের থাকে সমগ্র উম্মতের জন্য দরদভরা অন্তর, অশ্রুভরা আখি এবং সদা সজাগ-জাগ্রত মস্তিস্ক। এমন ক্ষণজন্মা, কালজয়ী সিংহপুরুষদের অন্যতম হচ্ছেন দক্ষিণ চট্টলার ইলমে ওহীর নীলাভাকাশ হতে কষে পড়া এক উজ্জল নক্ষত্র, বহুমাত্রিক বিরল প্রতিভা সম্পন্ন, এতদঞ্চলের মাটি ও মানুষের প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, সদ্য ঝরে পড়া আজিজী কাননের আখেরী পুষ্প, আজিজী উদ্যানের কাঁটাবিহীন ফুল, পটিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আরবী, উর্দু ও ফার্সী ভাষার সব্যসাচী সাহিত্যিক ও কবি, ইলমে দ্বীনের বটবৃক্ষ, জগদ্বিখ্যাত আল্লাহর ওলী, কুতবে আলম মুসলিম জাতির বিবেক, কা-ারী ও সময়ের সূর্যসন্তান আল্লামা শাহ মুফতী আজীজুল হক রহ. এর একান্ত সুযোগ্য খলীফা, প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, ওলামা জগতের মুকুট, দ্বীন সম্রাট, প্রচারবিমুখ সুফী সাধক, লক্ষ ভক্ত ও মুরীদানের আশ্রয়স্থল, সাচ্চা পীরে কামেল, সুন্নাতে রাসূলের মূর্ত প্রতিক, প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারী শরীফের বিদগ্ধ ব্যাখ্যাকার ও ভাষ্যকার শায়খুল হাদীস আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইছহাক (প্রঃ ছদর সাহেব) হুযূর রহ.। যে নামটির সঙ্গে জড়িত আলেম-উলামা, আম-খাস থেকে আরম্ভ করে সর্বশ্রেণীর মানুষের শ্রদ্ধামিশ্রিত অনুভূতির ছোঁয়া। এতদঞ্চলের মাটি ও মানুষের যিনি প্রানের স্পন্দন। যিনি ইতিহাসের এক অমোচনীয় পৃষ্ঠা। এক বিস্ময়। এক শিহরণ। একাধারে যিনি ছিলেন, ত্যাগী ছাত্র, সুদক্ষ শিক্ষক, সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রথিতযশা আলেমেদ্বীন, আধ্যাত্মিক জগতের জ্যোতিষ্মান নক্ষত্র, একনিষ্ঠ সমাজ সেবক ও আকাবিরে উম্মতের গৌরবোজ্জ্বল প্রতিচিত্র। জীবন্ত কিংবদন্তী। যিনি চলনে-বলনে-কথনে ছিলেন সুন্নাতে রাসূলের সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। যার রেখে যাওয়া শিক্ষা-দীক্ষা এবং অনুসরিত পথাবলম্বন করে সত্য অনুসন্ধিৎসু একজন মুসলমান পেতে পারে তার পার্থিব বিকাশ ও মুক্তির পথ। জোগাড় করতে পারে পরকালীন পাথেয়। সম্বল। সাধনা ও আত্মত্যাগের পথ বেয়ে ধীর ও দৃঢ় কদমে এগিয়ে আসা এই বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বর্ণিল বার্ধক্য, ইলম, আমল, ইখলাছ, ইছলাহ ও দাওয়াতের পূণ্যময় আলোয় উদ্ভাসিত কর্মগাঁথা মহিমামন্মিত জীবন এবং সৌন্দর্যম-িত এ সফর কাহিনী তথা পূণ্যময় জীবনের প্রতিটি দিকই ছিল পথহারা পথিক ও অনাগত প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয়, অনুশীলনীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ।
প্রজ্ঞাদীপ্ত এ মহামনীষীর জন্ম ও বংশ পরিচয় :
হযরত আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইছহাক রহ. ১৯১৬ সালে আবহমান কাল হতে ভৌগলিক দিক দিয়ে গুরুত্ববহ প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত পর্যটন নগরী, নৈসর্গিক সৗন্দর্যের অনিন্দ্য সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন অপরূপা লীলাভূমি কক্সবাজর জেলার টেকনাফ উপজেলাধীন ণীলা ইউনিয়নের পূর্ব সিকদার পাড়া এক সুশিক্ষিত অভিজাত দ্বীনি পরিবারে ভুমিষ্ট লাভ করেন । তার সম্মানিত পিতার নাম মরহুম মাওলানা আব্দুর রউফ। পিতামহের নাম মাওলানা আব্দুস্ সুবহান। বলতে গেলে পরম সৌভাগ্যের মোহনা যে, তাঁর পিতা ও দাদা উভয়ে আলেম ছিলেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁর বংশপরম্পরায় আরো অনেক আলেম এবং নিতান্ত আল্লাহভীরু, দুনিয়াবিমূখ ও ধার্মিক লোক ছিলেন। শ্রদ্ধেয়া মাতার নাম শরফুন্নেছা। তাঁর মাতা ও ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়না ও উদারপ্রাণ মহিলা। তাঁরা দুই ভাই ও ছয় বোন। তাঁর অপর ভাই মরহুম মাওলানা খাইরুল বশর সাহেব। যিনি দীর্ঘদিন কক্সবাজার হাশেমিয়া আলীয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস ছিলেন এবং খণ্ডকালীন রঙ্গীখালী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন।
শিক্ষা-দীক্ষা :
১৯২১ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তিনি আপন পিতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক পড়া-লেখা শুরু করেন স্থানীয় পারিবারিক মাদ্রাসায়। ১৩৪৭ হিজরী মোতাবেক ১৯২৭ ইংরেজীতে মরহুম শাহ আবুল মনজুর রহ. হ্নীলা দারুস্সুন্নাহ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলে তিনি সেখানে ভর্তি হন এবং অতি সুনাম ও কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক স্তরের পড়া-লেখা সম্পন্ন করেন। পরে অনন্য মেধার অধিকারী বিরল প্রতিভাধর এই কিশোর অধিক জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে উচ্চতর জ্ঞানার্জনের অভিপ্রায়ে অদম্য স্পৃহা ও প্রবল আগ্রহভরে ছুটে যান তৎকালীন দক্ষিণ চট্টলার সাড়াজাগানো ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনি শিক্ষানিকেতন বাঁশখালী থানার অন্তর্গত পুইঁছড়ী সরকারী আলীয়া মাদ্রাসায় (প্রঃ ইজ্জত আলী মিয়ার মাদ্রাসা)। সেখানে তিনি এমন সব যুগশ্রেষ্ট আসাতিযায়ে কিরামের সান্নিধ্যার্জনের সৌভাগ্য অর্জন করেন, যাদের জ্ঞান-গরিমার যশ-খ্যাতি স্বদেশ সীমা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। যারা তাকওয়া ও আল্লাহভীতির উচ্চাসনে সমাসীন ছিলেন। সেখানে তিনি একাধারে ক’টি বছর চরম আত্মত্যাগ, অতুলনীয় ও ঈর্ষণীয় মেধা, সরলতা, সদাচার, আদর্শ ও চারিত্রিক সু-কৌমার্য, পড়া-লেখায় একাগ্রতা, অকৃত্রিম আনুগত্য প্রভৃতি গুণাবলীর মাধ্যমে অতিক্রান্ত করেন এবং উন্নত স্বভাব-চরিত্র দ্বারা সকলের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। সাথে সাথে আসাতিযায়ে কিরামদের যারপর নাই স্নেহ-ভালবাসা এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও নিবিঢ় পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উর্দু, ফার্সী, আরবী ভাষা ও সাহিত্যসহ ইলমে নাহু, ইলমে ছরফ, ইলমে ফিক্বহ, ইলমে মানতিক(যুক্তিবিদ্যা), ফালসাফাহ(দর্শনবিদ্যা), বালাগাত (অলংকারবিদ্যা) ইত্যাদি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং সেখান থেকে জমাতে উলা (ফাজিল) পাশ করেন। উল্লেখ্য যে, তখনকার সরকারী এবং ক্বওমী মাদ্রাসার মধ্যে তেমন কোন ভেদাভেদও ফারাক বিদ্যমান ছিল না। আখলাক্ব, মতাদর্শ ও নিছাব ছিল প্রায় এক ও অভিন্ন। ইতিমধ্যে তার সাথে পরিচয় ঘটে আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট, কুতবে জমান আল্লামা শাহ মুফতী আজীজুল হক্ব রহ. এর সঙ্গে। শুধু পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নয় বরং স্বল্প সময়ে গড়ে উঠে অন্তরঙ্গতা ও আত্মার গভীর যোগাযোগ। সঁপে দেন নিজেকে হযরতের হস্তে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার্জনের নিমিত্তে পরিচর্যার জন্যে। হযরতকে গ্রহণ করে নেন স্বীয় অনাগত ভাবী আধ্যাত্মিক চিকিৎসক হিসেবে। হযরত মুফতী সাহেব হুযূর সা. অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা তার অন্তর্নিহিত সুপ্ত প্রতিভা ও যোগ্যতার ঝলক অবলোকনে তাঁকে এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাকেন্দ্র, ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র, ঐতিহ্যবাহী হাদীস শিক্ষার পাদপীঠ, সকল ইলমের অন্যতম সূতিকাগার, সলফে ছালেহীন ও আকাবিরদের স্মৃতিবিজড়িত আযহারুল হিন্দ ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়নের পরামর্শ দেন। তিনি হযরতের পরামর্শক্রমে তাঁরই একান্ত অনুপ্রেরণায় পাড়ি জমান অজস্র ইতিহাসের স্বাক্ষরবাহী প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দে। সেখানে তিনি ইলমে জাহির-বাতিন উভয়ে পরিপক্ক, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতায় সমকালীন বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্ঠিকারী, আসলাফে উম্মতের অবিকল প্রতিচ্ছবি, আকছে উসওয়ায়ে রাসূল সা. ওয়া ছাহাবা রা., সময়ের সাহসী সন্তানগণের শরণাপন্ন হয়ে দাওরায়ে হাদীস শরীফ (মাস্টার্স সমমান) কোর্সে পড়া-লেখায় মনোনিবেশ করেন। দেওবন্দে অধ্যয়নকালে যাঁদের সংশ্রবে ধন্য হয়েছিলেন, তাঁদের মাঝে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়- শায়খুল আরব ওয়াল ‘আজম, আওলাদে রাসূল সাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, যুগশ্রেষ্ঠ ও বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিস, জ্ঞান ও আল্লাহভীতির সু-উচ্চ মর্যাদার সু-মহান আসনে অধিষ্ঠিত, উপমহাদেশ বিশেষতঃ পূর্বাঞ্চলীয় ভূ-খণ্ড যে ক’জন ত্যাগী মহাপুরুষের ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত তাঁদের শীর্ষতম, আজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যার কাছে প্রকৃত ঋণী, আযাদী আন্দোলনের অগ্রসেনানী, অকুতোভয় বীর সিপাহসালার, বিশ্ববিখ্যাত প্রজ্ঞাবান বুযুর্গ, মুজাহিদে মিল্লাত সাইয়্যিদ আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.। তাঁর অন্য সম্মানিত হীরকতুল্য শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে প্রনিধানযোগ্য হলেন হলেন-শায়খুল আদব মাওলানা ইজাজ আলী রহ., মাওলানা ইব্রাহীম বলিয়াবী রহ., মাওলানা ফখরুল হাছান রহ., মাওলানা জহীরুল হাছান রহ.ও মাওলানা জলীল আহমদ রহ. বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য।
অধ্যাপনা :
পড়া-লেখার ইতি টেনে দারুল উলুম দেওবন্দ হতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর হযরত তাঁর আপন শায়খ পটিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক কুতবে আলম আল্লামা শাহ মুফতী আযীযূল হক রহ. এর সাথে সাক্ষাতে মিলিত হন। হযরত মুফতী সাহেব হুযূর রহ. তাঁর চারিত্রিক সু-কৌমার্য ও দৃঢ়তা, অসংখ্যা গুণাবলী দ্বারা ভূষিত জ্ঞান-প্রজ্ঞা, উৎকৃষ্ঠ বোধশক্তি, সততা, উদারতা, আত্মত্যাগ, ইখলাছ ও দায়িত্ব সচেতনতা বিশেষতঃ তাঁর ভিতর লুকায়িত অমূল্য এক রত্ন তথা আধ্যাত্মিক শক্তির আধিক্য-বিপুলতা ও তাকওয়ার পরিধির বিস্তৃতি অনুধাবন পূর্বক বিমোহিত হয়ে তাঁকে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়ার শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রদান করেন। আত্মশুদ্ধির মঞ্চে শুদ্ধতার ছড়ি হাতে নিয়ে আল্লাহপ্রেমের মাঞ্জিলকে লক্ষ্য করে ছুটে চলা এই সৃজনশীল মহান অভিযাত্রী অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশের পাশাপাশি অব্যাহত রাখেন তাছাউফ-সুলূকের রাজপথেও জোরালো পদচারণা। কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছার দৃঢ় মনোবাসনায় করতে থাকেন হযরতের দিবা-রাত্র অষ্টপ্রহর গভীর পর্যবেক্ষণ ও সুনিপুণ তত্ত্বাবধানে আধ্যাত্মিকতার দীক্ষায় লাগাতার মুজাহাদাহ, নিরলস সাধনা ও কঠোর সংগ্রাম। এভাবেই তিনি সেখানে অত্যন্ত দক্ষতা ও কৃতিত্বের সাথে প্রায় দশ বছর শিক্ষকতা করেন। সেখানে ইলমে দ্বীনের প্রতিটি শাখায় তাঁর সরব উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল। সাথে সাথে তাঁর মুখ্যউদ্দেশ্য তাযকিয়া ও আত্মশুদ্ধির সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করে দুর্লভ মহার্ঘ্য ঈর্ষণীয় রত্নভাণ্ডার সংগ্রহ করে নিজেকে ধন্য ও মহিমাম-িত করেন। অতঃপর ১৯৫৭ সালে তিনি পটিয়া মাদ্রাসা থেকে চলে আসেন এবং মাতৃবিদ্যাপীঠ হ্নীলাস্থ জামিয়া দারুস্সুন্নাহ মাদ্রাসায় ছদরে মুহতামিম ও প্রধান মুফতী হিসাবে যোগদান করেন। তিনি তখন থেকে ওপারের যাত্রী হওয়ার পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত প্রায় সু-দীর্ঘ ৫৬ বছর যাবৎ শায়খুল হাদীস, ছদরে মুহতামিম ও প্রধান মুফতীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং যথাযথ তা পালনে এমন নৈপুণ্যের স্বাক্ষর বহণ করেন যার উপমা মিলা শুধু দুস্কর নয় অসম্ভবও বটে। যা কেবল হুযূরের অলৌকিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ণীলা মাদ্রাসা আর ছদর সাহেব যেন এক অপরের সম্পূরক, অবিচ্ছেদ্য অংশ ও সমার্থক শব্দ। এক অপরের সাথে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে, হ্নীলা মাদ্রাসার আলোচনায় হুযূরের নাম আর হুযূরের আলোচনায় হ্নীলা মাদ্রসার নাম অবধারিতভাবে চলে আসে।
ব্যক্তিগত জীবন ও কতিপয় স্বভাব-চরিত্র :
ব্যক্তিগত জীবনে হুযূর ছিলেন খুবই অমায়িক, বিনয়ী, নিরহংকার, কর্মবীর, শান্ত, সাদাসিধে, সরলমনা, অতিথিবৎসল, আড়ম্বরহীন, জ্ঞানান্বেষী, সুন্নাতে রাসূলের মূর্ত প্রতিচ্ছবি, কুরআন-হাদীসের জীবন্ত আমলী নমুনা, আসলাফে কিরামের ইলমী-আমলী উত্তরসূরী, শত বাধা-বিপত্তি আর প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শরীয়তের আলোকরেখায় জীবন পরিচালনাকারী যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ ও সর্ববিধ জ্ঞানে পারদর্শী এবং সর্ববিষয়ে দূরদর্শী-দূরবীন এক মহান ব্যক্তিত্ব। ছোট-বড় সবার সাথে অতীত পরিচিত ও একান্ত আপনজন সূলভ আচরণে অভ্যস্থ ছিলেন। উদারমনে অমলিন বদনে হাস্যোজ্জল চেহারায় মিলিত হতেন সবার সাথে। তাঁর আনন্দমিশ্রিত মুখে অত্যন্ত শ্রুতিমধুর প্রাঞ্জল, সহজ-সরল বাক্যালাপ ও কথোপকথনে সকলে বিমোহিত এবং বিমুগদ্ধ হত। যে কোন মজলিসে উপস্থিতিদের সাথে হাস্যরস সম্বলিত কথা-বার্তা ও কৌতুক স্ফুর্তিতে আম-খাছ সকলে আরো বেশী আকৃষ্ট হত। এক কথায় হুযূর ছিলেন মটির মত বিনয়ী মানুষ। হুযূরের চলন-বলন-কথন থেকে মাটির গুণাবলীরই বহিঃপ্রকাশ ঘটত। কারো জন্য বিন্দুমাত্র হিংসা, লেষ ও আক্রোশ পরিলক্ষিত হয়নি হুযূরের জীবনে। গীবত, পরনিন্দা,পরচর্চা, ছিদ্রান্বেষণ ও অহেতুক কথন-বচন থেকে যবানকে রাখতেন সম্পূর্ণরুপে সংযত। কর্মময় জীবনে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা ও শয়তানের ধূর্ততাপূর্ণ কুটিল প্রতারণা হতে আত্মরক্ষার্থে ব্যস্তময় সময় কাটানো এবং নিয়মানুবর্তিতা ছিল হুযূরের একান্ত প্রিয়। দিবা-রজনীর মূল্যবান সময়গুলোকে বিভিন্ন ভাগে বিভাজন করে অধ্যাপনা, নিয়মিত অজীফা আদায়, তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, পারিবারিক প্রয়োজনাদি পূরণ, শুভার্থীদের সাক্ষাতদান এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে ছুটে আসা বিভিন্ন স্তরের তৃষিত গ্রাহকদের সাথে যথারীতি তাছাউফ ও সুলূকের বিকিকিনিতে লেন-দেনে নিমগ্ন থাকতেন। প্রকাশ্যে-গোপনে, শয়নে-স্বপনে, সরবে-নিরবে, আনন্দে-বেদনায়, সুখে-দুঃখে, ভ্রমনে-বাসস্থানে, শ্বাসে-প্রশ্বাসে এক কথায় জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে আল্লাহ পাকের নৈকট্যার্জন ও আত্মশুদ্ধির উৎকর্ষ সাধনের নিমিত্তে সদা নিজেকে সাধনায় ব্রত রাখতেন। শারিরিক দূর্বলতা সত্তেও পথহারা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে, আপন প্রভূর সাথে সম্পর্কহারা অজস্র মানব কাফেলাকে স্বীয় প্রভুর সাথে গভীর যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিতে কিঞ্চিতের জন্যেও থেমে ছিল না তাঁর পথ চলা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ও দূর থেকে দূরান্তের আমৃত্যু তাঁর দাওয়াতী সফর অব্যাহত ছিল। জাগতিক কোন লোভ-লালসা তাঁর দরবেশী জীবনকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। লোকমুখে শ্রুত যে, তিনি এমন সততার উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন যা ভাবতেই অবাক লাগে। রূপ কথার মত আশ্চর্যজনক। সারল্যের পাশাপাশি বিস্ময়কর বিজ্ঞতার কারনে তাঁর কথায় এত প্রভাব ছিল যে, সকলে হৃষ্টচিত্তে তাঁর সিদ্ধান্ত মাথাপেতে নিতে বাধ্য হতেন। সকলে শিরোধার্য করে অকুন্ঠমনে গ্রহণ করে নিতেন তাঁর পরামর্শ ও মতামত। উচ্চ মনোবল ও অদম্য সাহস ছিল প্রবচনতুল্য। কাপুরুষতা ও হীনমন্যতা কভূ আঁচ করতে তাঁর জীবনে। কোন কিছুতেই তিনি অসত্য, অন্যায় এবং বাতিলের কাছে শির নত করেননি। সত্য ও হক্বের উপর থাকতেন পাহাড়সম অবিচল। কুরআন-সুন্নাহর বাতলানো পথ-ই একমাত্র ইহ-পরকালীন শাস্তি ও মুক্তির পথ, এ কথার উপর ছিল তাঁর অতুলনীয় দৃঢ় এক্বীন আর বিশ্বাস। কোন বাধা-বিপত্তি তাঁর এই অবিচলতা থেকে একচুল পরিমানও হটাতে পারত না। জীবনের প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে প্রিয়নবীজীর অনুপম আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছিলেন তিনি এক লৌহমানব। আপোষহীন সংগ্রামী অগ্নিপুরুষ। নিজের অধীনস্থ ও খাদেমদের প্রতি নিদারুণ অনুকম্পাশীল। তাদের সামর্থবহির্ভূত কষ্টসাধ্য কোন কাজের আদেশ প্রদান ছিল তাঁর স্বভাবপরিপন্থী। পরিবার-পরিজনের প্রতিও ছিল তাঁর অকল্পনীয় সদ্ব্যবহার। শরিয়তবহির্ভূত গর্হিত কোন কর্মক্রিয়া পরিলক্ষিত হলে তা অত্যন্ত হিকমত-প্রজ্ঞার সাথে স্নেহপরবশে ক্রমান্বয়ে ইছলাহ ও সংশোধনে সচেষ্ট হতেন। তড়িৎ কঠোরতাবলম্বন ছিল তাঁর স্বভাববিরোধী। ছোটদের প্রতি স্নেহ, বড়দের প্রতি যথার্থ ইজ্জত-সম্মান প্রদর্শন এবং যোগ্য ব্যক্তিদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন ও কদর করতে কিঞ্চিৎ পরিমাণও কুন্ঠাবোধ করতেন না। এটা যেন তাঁর স্বভাবজাত ধমে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
আধ্যাত্মিক জীবন :
তিনি ছিলেন আশৈশব আল্লাহর ওলী। ছাত্র জীবন থেকেই ইলমে বাতেনী তথা আত্মশুদ্ধির প্রতি ছিল তাঁর টানটান ভাব। প্রবল ঝোক। আর এই কারণেই তো খুব একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল হযরত মুফতী সাহেব হযূরের সাথে। তারঁই সুনিপূণ তত্ত্বাবধানে শুরু করেন তাছাউফের রাজপথে সরব পদচারনা। অধ্যাপনাকালে হযরত মুফতী সাহেব হুযূরের পরম স্নেহ-মায়া ও রূহানী ছত্রছায়ায় ক্রমান্বয়ে উৎকর্ষ সাধন করতে থাকে তাছাউফ-সুলূকের তরীকায়। গগনচুম্বী সু-বিশাল তাছাউফ প্রাসাদের প্রতিটি কপাটে মৃদু করাঘাত করতে করতে একেকধাপ অতিবাহিত করে অতি গোপনতম প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে মহামূল্যবান প্রচুর রত্ন-মানিক আহরণে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। পর্যায়ক্রমে গভীর নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের পর হযরত মুফতী সাহেব হুযূর রাহ. তাঁকে তাঁরই ছাঁয়াতলে আশ্রিত হয়ে সঞ্চিত ধন-রত্ন থেকে অর্জিত মুনাফা বিতরণের অনুমতি প্রদান করেন। তথা খেলাফত লাভে ধন্য হন। এই ময়দানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন আল্লামা সুলতান আহমদ নানুপূরী রহ., আল্লামা আলী আহমদ বোয়ালভী রহ., আল্লামা নুরুল ইসলাম ক্বদীম রহ., আল্লামা হুসাইন আহমদ রহ. (প্রকাশ বড় হুযূর), আল্লামা বজলুস সুবহান রহ. প্রমুখ সবিশেষ উল্লেখ করার মত। এই নিভৃতচারী মহান সাধক সারাটি জীবন আধ্যাত্মিক সাধনায় রত ছিলেন। ইবাদত-বন্দেগী ছিল তাঁর রূহানী খোরাক, রূহানীয়্যতের আলোকরশ্মি দ্বারা নিজে যেমন আলোকিত হয়েছেন তেমনি অনেক-অসংখ্য পূণ্যাত্মাকে করেছেন আলোকিত। তাঁর যাদুময়ী, বিস্ময়কর, আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্বের পরশে হাজারো পঙ্কিলযুক্ত পাপী-তাপী নিকৃষ্ঠতম মানুষ উৎকৃষ্ঠতম সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। হুযূর এমন প্রবল আধ্যাত্মিক ঐশী শক্তির অধিকারী ছিলেন, যা সাধারণ কারো পক্ষে কল্পনা করাও রীতিমত অসম্ভবপ্রায়। বাস্তব হাক্বীকত যার দৃষ্টিগোচর হয়নি, তার কাছে তা রূপকথা বা কল্পকথা মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বয়োঃবৃদ্ধির ভারে এতো ন্যুজ ও নানাবিধ রোগ-ব্যাধির উপদ্রবে এতো দুর্বল হয়ে গেছে যে, কারো সাহায্যবিহীন নিজে নিজে দাঁড়ানো কিংবা চলা-ফেরা করার তো প্রশনই উঠে না বরং অন্যের সাহায্যেও ঠিকমত দাঁড়াতে কিংবা চলা-ফেরা করাটাই মুশকিল এমতাবস্থায়ও নামাজের সময় হলেই সুস্থ-সবল মানুষের মত দাঁড়িয়ে অতি একাগ্রতার সাথে নামায আদায় করতেন। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, নামাযান্তে আর নিজে নিজে দাঁড়াতে পারতেন না। শুধু তা নয়, মৃত্যুর শিয়রে এসে দাড়ানোর আগ পর্যন্ত একদিনের জন্যেও থেমে ছিল না তাঁর চিরাচরিত নিয়মমাফিক বিনিদ্র রজনীর অশ্রুপাত। শেষনিশির তাহাজ্জুদ। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে জর্জরিত দেহে বসে বসে প্রত্যহ দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন। কারো আমন্ত্রণে কোথাও গেলে কিংবা কোন মজলিসে উপস্থিত হলে কিছু না কিছু নছীহত-উপদেশ কমপক্ষে একটি হাদীছ শরীফ হলেও সমবেতদের উদ্দেশ্যে বয়ান না করে ফেরাটা ছিল হুযূরের স্বভাবপরিপন্থী। বিশেষতঃ নামাযের প্রতি এতই যত্নবান ছিলেন যে, নামাযের সময় হওয়ার সাথে সাথে তাঁর মুখাবয়বে অস্থিরতার ভাব লক্ষ্য করা যেত। যে কোন সময় যে কোন কারণে মসজিদে প্রবেশ করলে তাহিয়্যতুল মসজিদের নামাজ আদায় করা ব্যাতিরেকে হুজুরকে বসতে কখনো দেখা যায়নি। এমনিভাবে কোন দু‘আর মজলিসে উপস্থিত হলেও কথা-বার্তা ও অন্য কাজের অগ্রভাগে দু,রাকা‘আত নফল নামায পড়ে নেয়াটা তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। দিবা-রজনীর চব্বিশ ঘন্টা অতিবাহিত হত আল্লাহ পাক রাব্বুল ‘আরামীনের যিক্র, স্মরণ ও ধ্যানে। সমগ্র শরীরের শিরা-উপশিরায় যেন জারি হয়ে গিয়েছিল আল্লাহ পাকের নামের তাসবীহ“আল্লাহু আল্লাহ”। নামাযে দন্ডায়মানবস্থায় মনে হত তিনি নবীজীর সা. পুতঃপবিত্র যবান নিসৃত অমোঘ সত্যবাণী “ তুমি আল্লাহ পাকের ইবাদত এমনভাবে কর যেমন তুমি আল্লাহ পাককে সরাসরি দেখতে পাও, আর যদি তুমি এই স্তরে উপনীত না হতে পার, তাহলে অন্তত এ ধারণা পোষণ কর যে, আল্লাহ পাক তোমাকে দেখছেন” এর বাস্তব মিছদাক্ব-প্রতিপাদন।
অপূর্ব ঈমানী শক্তি ও জিহাদী প্রেরণা :
হুযূর ছিলেন অপূর্ব ঈমানী শাক্ততে বলীয়ান ও জিহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত। আর্তপীড়িত মানবতার তরে তাঁর মন কাঁদত সদা-সর্বদা। তাদের আহাজারী ও দুর্গতির খবর শুনে কেঁপে উঠত তাঁর তনু-মন। এমনিই লক্ষ্য করা যেত হুযূরের বচন-কথন ও ভাব-ভঙ্গিমায়। শুধু স্বদেশ নয় পুরো মুসলিম মিল্লাতের উপর আবর্তিত সমূহ বিপদাপদ, দুঃখ-দুর্দশা, দুর্যোগ, কফির সম্প্রদায় কতৃক নির্যাতন-নিপীড়ন ও অত্যাচার দারুণভাবে আহত করত এই মানবদরদীর কোমল হৃদয়কে। সাম্প্রতিক মিয়ানমারে মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যে সংঘটিত বৌদ্ধ-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নির্যাতিত অসহায় মজলুম মানবতার জন্য হুযূর যে রকম ব্যকুল ও অস্থির হয়ে পড়েন তা একমাত্র হুযূরের সান্নিধ্যার্জনকারী ছাড়া কারো বোধগম্য হবার নয়। তৎসময়ে যে হুযূরের সাহচর্যে ও সংস্রবে এসেছে সেই পরতে পরতে উপলদ্ধি করতে পেরেছে, কী বর্ণাতীত ঈমানী সঞ্জীবনী শক্তি এবং জিহাদী প্রেরণা বিরাজমান ছিল তাঁর দেহখাচায়। যে কোন সভা-মজলিসে সমাগত সবাইকে সম্বোধনসূচক শব্দ দ্বারা কাছে ডেকে ব্যথিত হৃদয়ের অনুযোগ ব্যক্ত করতে দেখা যেত যে, যখন কোন দেশে মুসলমানদের উপর কাফিররা নির্যাতনের ষ্টীমরোলার চালাতে থাকে এবং সে দেশের মুসলমানরা রোধ-প্রতিরোধে অক্ষম হয় তখন পাশ্ববর্তী দেশের মুসলমানদের উপর তাদের সার্বিক সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া নামায-রোযার মত ফরয হয়ে দাড়ায়। বর্তমানে আমাদের নিকটবর্তী বর্বর হত্যাযঙ্ঘ ও অনির্বচনীয়-অকথ্য নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষ হয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই পাওয়ার আর শক্তি আমাদের নেই। এরপরও কি আমরা মহাপ্রতাপশালী আল্লাহর দরবারে দায়মুক্ত হব? পরিত্রাণ পাব? তাঁর কঠিন পাকড়াও থেকে রক্ষা পাব? না-না কখনো না। আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কষ্ট দেন না। সুতরাং আমাদের সাধ্যসীমায় যা আছে তা করা থেকে যদি আমরা বিরত থাকি, তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাকের আদালতে হতে হবে অভিযুক্ত। আসামি। তাহলে আমাদের করণীয় কী? আমি তোমাদেরকে একটা আমল বাতলিয়ে দিচ্ছি, যা করলে ইনশা আল্লাহ আশা করা যায় আল্লাহ পাকের সামনে জবাবদিহিতা থেকে বাঁচতে পারবে। আবার তা কোন কঠিন আমল নয়। অতি সহজ। সকলে সার্বক্ষণিক অনায়াসেই যা করতে পারে। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তির। সামন্যতম আগ্রহের। একটু মনোযোগের। আর তা কাফিরদের প্রতি শত শত হাজার হাজার লক্ষ-কোটি অব্যর্থ খোদায়ী ক্ষেপনাস্ত্র, এটমবোম নিক্ষেপ করা। এই মহৎ আমলটি হচ্ছে-আমরা বার্মা অভিমুখী হয়ে বেশি বেশি “লা-হাওলা ওয়া লা-কুওয়্যাতা ইল্লা-বিল্লাহ্” পাঠ করি। এটা মনগড়া কোন মন্ত্র নয় বরং হাদীছ শরীফে পাওয়া আমল। ইনশা আল্লাহু তা‘আলা কাফিরদের শক্তি হ্রাস পাবে আর মুসলমানদের ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পাবে। কাফিরদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে আর মুসলমানদের বিজয় সুনিশ্চিত হবে।
তিনি সদা সময় যা বলতেন :
তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজ ও নছীহতপুঞ্জ হতে সত্যানুসন্ধানী একজন মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধনকারী ক’টি অতি মূল্যবান হীরকতুল্য নছীহতমালা ও উপদেশবাণী হচ্ছে-
১. তোমরা যদি আল্লাহর নৈকট্যশীল মাহবুব বান্দাহ হতে চাও, আল্লাহর হাবীব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাচ্চা অনুসরন-অনুকরণ কর। যদি স্বীয় জীবনকে প্রিয় নবীজীর সা. সুন্নাতের গ-িতে পরিচালিত করতে পার এবং তাঁর আনীত শরীয়তের অনুগত হতে পার তাহলে আল্লাহ পাক তোমাদেরকে মুহাব্বত করবেন, ভালবাসবেন। আর আল্লাহ পাকের প্রিয় বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া ও নৈকট্যপ্রাপ্তদের কাতারে শামিল হওয়ার প্রধান মূল উপায় হচ্ছে মুহাব্বত আর ভালবাসা। আর এ মুহাব্বত নির্ভরশীল একমাত্র রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণের উপর।
২. ইলম, আমল, ইখলাছ সৃষ্টির চেষ্টা কর। আল্লাহর মুহাব্বত সৃষ্টি হবে। আল্লাহর মুহাব্বত সৃষ্টি হলে আমল করা সহজ হবে এবং স্বাদ আস্বাদন করা যাবে। কারণ স্বাদবিহীন কোন কিছুতেই তৃপ্তি পাওয়া যায় না। বেহেশতী জেওর হতে ইলম শিখে সে অনুপাতে আমল কর এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কর, এই তিনটি কাজ করতে পারলেই পাক্কা ঈমানদার হয়ে যাবে।
৩. হুযূর দাঁড়ি রাখার প্রতি জোর তাগিদ দিয়ে বলতেন, দাঁড়ি সমস্ত আম্বিয়া কিরামের সুন্নাত ও পুরুষদের শোভাবর্ধনকারী এবং ঈমানের রক্ষাকবচ। প্রত্যেক মূল্যবান জিনিসের হেফাজতের জন্য যেমন ভাউন্ডারী থাকে তেমনি ঈমানের ভাউন্ডারী হচ্ছে দাঁড়ি। দাঁড়ি ঈমানকে পরিবেষ্টন করে আছে, যাতে ঈমান নিরাপদে থাকে। নষ্ট না হয়ে যায়।
৪. সাদা দাঁড়িতে মেহেদী লাগানোর প্রতি খুব বেশি তাগিদ দিয়ে বলতেন, ছহীহ বুখারী শরীফের হাদীস শরীফে আছে রাসূল সা. দাড়িতে নিজেই মেহেদী লাগাতেন এবং ছাহাবাদেরকে নির্দেশ দিতেন আর বলতেন, ‘তোমরা ইয়াহুদী এবং মুশরিকদের বিরোধীতা কর’ সুতরাং দাঁড়িতে মেহেদী লাগানো সুন্নাত বিধায় আমি নিজেও লাগায় তোমরাও লাগাও।
৫. হুযূর সবসময় বলতেন, উঠা-বসা, চলা-ফেরা সর্বাবস্থায় কালিমা শরীফ তথা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বেশি বেশি পাঠ কর। এই কালিমা দিয়ে ঈমানক্ষেতে ঘিরা দাও। ঈমানকে নবায়ন কর। কারণ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ দ্বারা ঈমান তাজা হয়। ঈমানে পানি আসে।
৬. যে কোন সংকট, বিপদাপদ, বলা-মুসিবত, দুঃখ-দুর্দশা, দুর্যোগ ও সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য লা-হাওলা ওয়া লা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহি বেশি বেশি পাঠ কর। ইনশা আল্লাহ সব সমস্যা আল্লাহ পাকের গায়বী খাজানা থেকে সমাধান হয়ে যাবে। এটি একটি অব্যর্থ নুসখা। এছাড়াও যাবতীয় পেরেশানী ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। হাদীস শরীফে এর আরো অনেক ফজীলত বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং প্রতিটি মুহুর্তে এই অজীফা পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
৭. হুযূর হরহামেষা বলতেন যে, তোমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হও। পাঁচ ওয়াক্ত নামায সময়মত সযত্নে পালন কর। ইনশা আল্লাহ আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দাহগণের অন্তর্ভুক্ত হতে কোন অন্তরায় থাকবে না। আল্লাহর খাঁটি বান্দাহ হয়ে যাবে। আল্লাহর গায়বী খাযানা থেকে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং সকল মুশকিল আসান হয়ে যাবে। কারণ আল্লাহ পাক নিজেই পবিত্র কুরআনে বলেছেন-“ তোমরা ধৈর্য্য এবং নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর”।
৮. হুযূর কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের প্রতি বেশী গওরুত্বারোপ করে বলতেন-তোমরা দৈনন্দিন নিয়মিত বেশী বেশী কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করবে। অপারতপক্ষে এক-আধ পৃষ্ঠা হলেও করবে। বুঝে হোক কিম্বা না বুঝে হোক। কারণ আল্লাহ পাকের পবিত্র কালামের তিলাওয়াত দ্বারা নিঃসন্দেহে ঈমান বৃদ্ধি পায়। অন্তরে নূর সৃষ্টি হয়। বাল্যকালে না শেখার কারণে কেউ পড়তে না জানলে সেও কুরআন শরীফের প্রতিটি লাইনের দিকে গভীর নজর দিয়ে আঙ্গুল চালিয়ে যাবে আর মনে মনে স্মরবে যে, এটা মহান আল্লাহ পাকের কালাম। ইনশা আল্লাহু তা‘আলা এতেও ফায়দা হবে। তবে মনে রাখতে হবে, আল্লাহ পাকের দরবারে না শেখার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে এবং সাধ্যমত শেখার প্রচেষ্ঠাও চালিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় গোনাহগার হবে।
যে ভাবে চলে গেলেন ওপারে :
দিনটি ছিলো সোমবার। ৮ ই জুলাই ২০১৩ ইংরেজী। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে চলতে লাগল অন্য দিনের মত। আছরের নামাযের জন্য অযূরতাবস্থায় আকস্মিক তিনি ঢলে পড়েন। সে দিন হতে ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে পরিবারের সদস্যরা তাকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফুয়াদ আল-খতিব হাসপাতাল কক্সবাজার হয়ে ১৬ ই জুলাই চট্টগ্রাম সিএসসিআর ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, হুযূর পরিবারের সদস্যদেরকে সজোর অনুরোধ করে বলেছিলেন-তোমরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেয়ো না। কারণ আমার দু’দিনের এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এর পূর্বমূহুর্তে বারংবার বলে আসছিলেন, আমার আখেরী ওয়াক্ত। আমি এই বৎসর পবিত্র রমাযান মাসে মায়াময়ী এ পৃথিবী থেকে চলে যাব। কিন্তু হিতাকাঙ্খীমহলের অনুরোধের তাড়নায় তাঁকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের করতে বাধ্য হলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। পর্যায়ক্রমে শারীরিক অবস্থা দিনের পর দিন আরো বেগতিক হতে লাগলে ক’দিন তাঁকে চট্টগ্রামের সিএসসিআর ক্লিনিকে নিবিঢ় পর্যবেক্ষণে (সিআইসিইউ-তে) রাখা হয়। চিকিৎসকদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, বয়োঃবৃদ্ধির কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ রক্তশূণ্যতা, হার্ট ও উচ্চ রক্তচাপজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগার দরুণ তাঁর স্বাস্থের মারাত্মক অবনতি ঘটে। শেষ পর্যন্ত ২৪ জুলাই ২০১৩ ইংরেজী, ১৪ রমাযান ১৪৩৪ হিজরী বুধবার দুপুর ২.৫০ মিনিটে কারো অজান্তে চুপিসারে হাস্যোজ্জল চেহারায় পাড়ি জমান পরপারের উদ্দেশ্যে। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে অবলীলায় ইহধাম ত্যাগ চলে গেলেন পরম প্রিয়তমের সান্নিধ্যে। মৃত্যুর সুশীতল পরশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে পড়েন ইসলামের এই মহান একনিষ্ঠ সেবক। অবগাহন করলেন চির শান্তির সরোবরে। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই আছে শুধু আমাদের মানসপটে তাঁর স্মৃতি, আদর্শ চারিত্রিক সু-কৌমার্য ও চিন্তা-চেতনা। তাঁর মৃত্যু সংবাদ বিদ্যুৎবেগে সবৃত্র ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুধু হ্নীলা নয় পুরো টেকনাফজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। হুযূরের শিষ্য, ভক্ত, অনুরক্ত এবং আম জনতা সবাই হয়ে পড়েন শোকাভিভূত ও মর্মাহত। সকলের মুখাবয়বে ফুটে উঠেছিল প্রিয়জন হারানোর বেদনার চাপ। হুযূর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দুপুর আড়াইটায়। ক্লিানক্যাল কার্যাদি সম্পাদনের পর তাঁর শবদেহ নিয়ে যখন নিজালয়ে ফিরতির উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ইত্যাবসরে তাঁর ইন্তেকালের কবর মুহুর্তের মধ্যে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার দায়িত্বরত শিক্ষকগণের মাধ্যমে বর্তমানে আরব আমিরাতে অবস্থানরত পটিয়া মাদ্রাসার বর্তমান মহা পরিচালক স্ব-যামানার দার্শনিক, সর্ববিধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহা প-িত, উলামায়ে দেওবন্দের অহংকার, হযরতের সুযোগ্য খলীফা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, প্যখ্যাত হাদীস বিশারদ, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবি ও দার্শনিক আল্লামা মুফতী আব্দুল হালীম বুখারী সাহেব (দা.বা.) এর কর্ণকুহুরে পৌঁছলে তিনি সকলের সাথে মতবিনিময় করে সর্বসম্মতিক্রমে মরহুমকে তাঁর প্রাণপ্রিয় শায়খ কুতবে যামান হযরত মুফতী আযীযুল হক রহ. এর মাজারের পার্শ্বে সমাহিত করার জন্য জামিয়া কতৃপক্ষের পক্ষ হতে মরহুমের পরিবারের প্রতি প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু হাজারো শিষ্য, ভক্ত-অনুরক্ত ও লাখো মানুষের প্রাণের আকুতি ও ভালবাসার টানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পৈত্রিক নিবাসভূমিতে নিয়ে আসার অনুরোধ করা হলে জামিয়া কতৃপক্ষের পক্ষ হতে মরহুমের পরিবারের সদস্যদের কাছে সজোর এ আবদার করা হয় যে, কমপক্ষে ফিরতি পথে যেন এই মুবারক অযিাত্রীকে পটিয়া মাদ্রাসায় ঢুকিয়ে গোসল ও কাফন দেয়া হয়। জামিয়া কতৃপক্ষের তামান্না ও আকাংঙ্খানুযায়ী সেখানে যাত্রাবিরতি করে জামিয়ার মুফতী, মুহাদ্দিস ও সর্বক্ষেত্রে যুগের শ্রেষ্টতম ব্যক্তিবর্গের বরকতময় হস্তে এই পূণ্যময় মহামনীষীর গোসল ও কাফন দেয়া সম্পন্ন করা হয়। তৎপর যখন পটিয়া মাদ্রাসা থেকে হুযূরকে বহনকারী গাড়ীযোগে নিজ গ্রামে নিয়ে আসা হচ্ছিল, তখন পথে পথে তাঁকে শেষ বারের মত এক নজর দেখার জন্য জনতার ঢল নেমেছিল। শোকাচ্ছন্ন ও বেদনাপ্লুত হৃদয়ে ফিরতি সড়কের মোড়ে মোড়ে উন্মুখ হয়ে দাড়িয়ে থাকা জনসমাগমের আবেগের তাড়নায় থেমে থেমে পথাতিক্রমের কারণে পৌঁছতে অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল। পরে যখন নিজ পৈত্রিক নিবাসে এসে পৌঁছল, তখন প্রত্যন্তাঞ্চল হতে ছাত্র, ভক্ত ও অনুরাগী সহ প্রাণপ্রিয় বন্ধুটির অন্তিম দর্শন লাভে উৎসুক সাধারণ জনতার স্রোত নামতে শুরু হল। পুরো ণীলাজুড়ে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্র থেকে ছিল মানুষের কোলাহল। অলিগলিতে যে দিকে দৃষ্টি যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে কল্পনাতীত হারে বাড়তে থাকে জনতার মিছিল। কী অভূতপূর্ব দৃশ্য! জানাযার নামাযের সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, ততই বৃদ্ধি হতে চলছিল শুধু ককসবাজার জেলা নয় পুরো চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চল হতে আগত মানুষের ঢল। যাদের দু’গাল বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল শোকাশ্রুর বাঁধভাঙ্গা স্রোতধারা। তাদের ক্রন্দনরোল-আহাজারী ও শোকসন্তপ্ত পদচারণায় যে হৃদয়বিদারক দৃশ্য সৃষ্টি হয়েছিল তা এতদঞ্চলের মানুষের নিকট বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল। জুহুরের নামাযের পর সরেজমিনে উপস্থিত থেকে দেখা যায় জানাযার নামাযের জন্য ঘোষিত বিশালায়তনের খোলা মাঠ লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। কোথাও বিন্দুমাত্র তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। পূর্ব ঘোষণানুযায়ী ঠিক দুপুর ২.৫০ মিনিটে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। হুযূরের জানাযার নামাযে ইমামতি করার সৌভাগ্য অর্জন করেন তাঁরই সুযোগ্য বড় ছাহেবজাদা, ণীলা দারুস্সুন্নাহ মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষক মাওলানা আব্দুর রহমান সাহেব (দ.বা.)। এর পর তাঁকে পারিবারিক গোরস্থানে তাঁরই অছিয়্যত মতে ণীলা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা শাহ আবুল মনজুর রহ. এর পাশে লাখো মানুষের তপ্তাশ্রুজলে দাফন করা হয়। এভাবেই সবাইকে এতীম বানিয়ে না ফেরার দেশের যাত্রী হলেন সর্বক্ষেত্রে অধঃপতিত একটি জনপদে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার-প্রসার ও শরীয়তবিরোধী সকল প্রকারের অপসংস্কৃতি-অপপ্রথা বিদূরীকরণ ও বিমোচনে আজীবন নীরব সংগ্রামকারী বিপ্লবী এই সমাজ সংস্কারক। আহ! ইলমে নববীর আকাশ হতে কষে পড়ল এমন একটি আলোকপ্রদ দীপ্তিমান উজ্জ্বল নক্ষত্র যার জ্যোৎস্নায় ঝলমল করে আলোকিত হয়ে উঠত সর্বত্র। ঝরে গেল আজিজী কাননের সেই আখেরী পুষ্পটি, যে ফুলের মনমাতানো সৌরভ মুখরিত করে তুলেছিল সবাইকে। যার সুগন্ধি মুগ্ধ করেছিল পুরো জাতিকে। এমন মৃত্যুকেই বলা হয়েছে হাদীছের ভাষায় “ একজন আলেমের মৃত্যু আলমের (দুনিয়ার) মৃত্যুর সমতুল্য। প্রমত্ত সাগরের উচ্ছল উর্মিমালার ন্যয় দ্রুতবেগে ধেয়ে আসা বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার ও অপসাংস্কৃতির সয়লাবে যখন ইসলামী জীবনধারা সংকটাপন্ন। অপসাংস্কৃতির হিংস্র নখরাঘাতে যখন ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ছিন্নভিন্ন। পুরো মুসলিম উম্মাহ যখন বিজাতিদের সুপরিকল্পিত বহুমাত্রিক আগ্রাসনের করাল গ্রাসের শিকার। ঠিক জাতির এহেন করুণ সংকটময় ও প্রতিকূল মূহুর্তে প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, সত্য-ন্যয়ের পথের অগ্রপথিক, গন্তব্যহারা মানুষের পথের দিশারী, জাতির দুর্দিনের অনন্য রাহবার, আধ্যাত্মিকতার এই প্রাণপুরুষ! গোটা জাতিকে নাবিকবিহীন পথভোলা নৌযানে ভাসমানরতাবস্থায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন ওপারে। সত্যিই, এই মহান ব্যক্তিত্বের বিয়োগে যে অপূরণীয় ঘাটতি হলো তা আজ, কাল, পরশু কখনো পূরণ হবার নয়।
জানাযার নামাযে অংশগ্রহন করেছিলেন যারা :
হুযূরের জানাযার নামাযে এমন অগণন অসংখ্য দেশবরেণ্য আলেম-উলামা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়েছিলেন যার সঠিক পরিসংখ্যান জানা শুধু কষ্টসাধ্য নয় অসম্ভবও বটে। শুধু এতটুকু বলা যেতে পারে যে, দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সকল মাদ্রাসার সকল মতের উলামা-মশায়েখ, বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের নেতা-কর্মীগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বশ্রেণীর পেশাজীবি ব্যক্তিবর্গের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহনে এমন লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতে জানাযার নামায পুরো দক্ষিণাঞ্চলের কোন স্থানে কখনো অনুষ্ঠিত হয়েছে কিনা তা এলাকার বৃদ্ধারা পর্যন্ত স্মরণ করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। তারপরও শোকসন্তপ্ত পরিবার ও বিচ্ছেদজর্জরিত শোকার্ত ভক্ত-অনুরাগীদের প্রতি শান্তনার কোমল পরশ বুলিয়ে দিতে হন্য হয়ে ছুটে আসা খ্যাতনামা ব্যক্তিগণ হতে যারা জানাযাস্থলে সময়ের সংকীর্ণতা সত্ত্বেও সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে ক’টি কথা রেখেছিলেন তাদের ক’জনের নাম পত্রস্থ না করলে মনে হয় কার্পণ্য করা হবে, সমীচিন হবে না- বাংলার প্রথিতযশা আরবী সাহিত্যিক ও কবি, শরীয়তশোভন সংস্কারে দৃঢ় বিশ্বাসী, শ্রোতামুগ্ধকারী বক্তা, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, শাহী পোষাকে আবৃত বুযর্গ, হযরত বাবুনগরী সাহেব হুযূর রহ.-এর স্বনামধন্য খলীফা, পীরে কামিল আল্লামা সুলতান যওক নদভী সাহেব, পীরে কামিল আল্লামা আবুল অফা শমসী সাহেব, পটিয়া মাদ্রাসার প্রতিনিধি দলের পক্ষে বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন, দক্ষ ফিকাহবিদ, ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ আল্লামা মুফতী শমসুদ্দীন জিয়া সাহেব, উখিয়া টেকনাফের বর্তমান সাংসদ আলহাজ্ব আব্দুর রহমান বদি সাহেব, সাবেক সাংসদ আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরী, সাবেক সাংসদ আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী সাহেব, টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মুহাম্মদ শফিক মিয়া সাহেব, উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজালাল চৌধুরী, বিশিষ্ট সমাজ সেবক হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মাওলানা নূর আহমদ আনোয়ারী, ণীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাষ্টার মীর কাসেম সাহেব প্রমুখ।
যা রেখে গেলেন :
এই মহান মুকুটবিহীন সম্রাট! মুত্যুকালেএক স্ত্রী, নয় পুত্র, ছয় কন্যা ও বেশকিছু নাতি-নাতনী সহ স্বদেশ পেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য-অগণিত ছাত্র, ভক্ত-মুরীদান, ভাবশিষ্য এবং অজস্র গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। এছাড়াও কালের এমন যোগ্যতম শ্রেষ্ঠ রূহানী সন্তানগণ রেখে গেছেন, যারা হযরতের নিকট হতে ইলম ও আমলের অমিয় সুধা পান করে গোটা জগতবাসীর কাছে অকার্পণ্যচিত্তে যথারীতি তা বিতরণ করে যাচ্ছেন। তৃষ্ণার্ত মানবের তৃষ্ণা নিবারণে অকাতরে স্বীয় জীবনকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। মানুষ গড়ার এ মহান কারিগরের শিষ্যগণের তালিকা এত দীর্ঘ যে, ক্ষুদ্র পরিসরের এই প্রবন্ধে তা কলমবদ্ধ করা সম্ভবপর নয়।
লেখা-লেখির জগতে তাঁর বিচরণ :
বহুমুখী যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার পাশাপাশি অসাধারণ লিখনীপ্রতিভাও অন্তর্নিহিত ছিল তাঁর ভিতর। মাদ্রাসার পক্ষ হতে নিজ স্কন্ধে অর্পিত গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির দৈনন্দিন নিয়মিত দরস প্রদান, দূর-বহুদূর থেকে আধ্যাত্মিকতার সবক নিতে আগত ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাতদান, দূরদুরান্তে ওয়াজ-নছীহত ও দাওয়াতী সফরের ঘনব্যস্ততার দরুণ লেখা-লেখির দুনিয়ায় তেমন সময় ব্যয় করতে না পারলেও আবার এক্ষেত্রে একেবারে শুন্যের কৌঠায়ও নয়। এমন কর্মতৎপরতার ফাঁকে- ফাঁকেও রচনা করেছেন ক্ষুদ্র কলেবরের ক’টি মূল্যবান পুস্তিকাও। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, স্বীয় শায়খ কুতবে আলম মুফতী আযীযুল হক রহ. এর আদর্শ ও দীপ্তিময় কর্মজীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে রচনাকৃত দুই খ-ের অনবদ্য সংকলন“কামালাতে আযীয”।
উপসংহার :
এ কথা সর্বজনবিদিত সত্য যে, সদ্য মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হওয়া ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষটি শুধু একটি ব্যক্তি নয় একটি জাতি। একটি জীবন নয় একটি ইতিহাস। একটি বিপ্লব। একজন সাধারণ মানুষ নয় একটি বিশুদ্ধতম প্রতিষ্ঠান। একটি শতাব্দী। তাঁর মৃত্যুতে মাটি চাপা পড়ে গেল একটি দাস্তান। একটি স্বর্ণালী অধ্যায়। একটি জীবন্ত ইসলামী বিশ্বকোষ। একটি পৃথিবী। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, আছে শুধু তাঁর কর্মময় স্মৃতি আর বর্ণাঢ্য ইতিহাস। আমরা যারা তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে বেচে আছি, সকলে যেন তাঁর এ স্মৃতিগুলো বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে না ফেলি এবং এ বর্ণাঢ্য ইতিহাস যেন শুধু শুধু উপখ্যানে পরিণত না করি; এই প্রত্যাশা করবো সকলের তরে চিরকাল। চিরদিন। আর আল্লাহ রাব্বুল ইয্যতের দরবারে এ প্রার্থনা করবো যে, তাঁর এই স্মৃতিগুলো যেন মশালরূপে দিকভ্রান্ত নাবিকের পথ দেখানোর মত ভাস্বর হয়ে জ্বলে উঠে আমাদের জীবনে। তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য সুষমা ও আদর্শে উজ্জীবিত হওয়ার স্পৃহা যেন আমাদের জীবনের প্রতি পদে পদে সবল থাকে, দুর্বল হয়ে না যায়। গতিবেগ যেন সচল থাকে, মন্থর না হয়ে পড়ে। বরং প্রতিনিয়ত যেন বৃদ্ধিতর হারে ঘটতে থাকে তাঁর আদর্শের প্রতিফলন।
পরিশেষে মহামহিম আল্লাহ পাকের মহান দরবারে বিনীত স্বরে ফরিয়াদ জানায়, তিনি যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্ব্বোচ্চ মাকামে স্থান দান করেন এবং আমাদেরকে তাঁর রূহানী ফয়য ও বরকতে আন্দোলিত হয়ে তাঁর পদাংক অনুসরণের তাওফীক দান করেন। আমীন।
……………………………………………………………….
মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া টেকনাফ,
সম্পাদক, দৈনিক সাগরদেশ কক্সবাজার ও মাসিক আল-আবরার ঢাকা